তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুল কেঁটে বিলুপ্ত করা হয়েছিল ঢাকাই মসলিন! ইতিহাস না কি পৌরাণিক গল্প?

সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সুবাদার ইসলাম খান সর্বপ্রথম রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন ১৬১০ সালে। সেই হিসেবে ‘ঢাকা’ চারশো বছর ধরে ইতিহাসে স্থান দখল করে আছে। ঢাকার প্রসিদ্ধির ইতিহাস খুব বেশি পুরানো না হলেও ঢাকাই মসলিনের কালজয়ী প্রসিদ্ধির ইতিহাস সর্বজনবিদিত।

মসলিন শব্দটি এসেছে ‘মসুল’ থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র ছিল মসুল। সেখানেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হত। ‘মসুল’ এবং ‘সূক্ষ্ম’- এই দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা এই কাপড়ের নাম দেয় ‘মসলিন’।

যদিও বাংলার ইতিহাসে মসলিন বলতে বোঝানো হয় সোনারগাঁও (ঢাকা) ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম এক ধরনের কাপড় যাকে ‘ঢাকাই মসলিন’ বলা হত। মসলিন তৈরি হত ফুটি কার্পাস নামক এক বিশেষ তুলা থেকে যার বৈজ্ঞানিক নাম Gosseypium Arboreum Var Neglecta। মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের উর্বর জমিতে এই তুলার চাষ হত। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া মসলিন সুতা কাটার জন্য উপযোগী। জনশ্রতি রয়েছে যে, ১৮-৩০ বছর বয়সের মেয়েদের আঙ্গুলে এই সুতা সবচেয়ে মিহি হত। মেয়েরা ভোর বেলায় উঠত এই সুতা কাটতে, সূর্য মাথার উপর উঠলে সুতা মিহি হবে না বলে বিশ্বাস করত।
ফ্রান্সিস রেনাল্ডি অঙ্কিত বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'লেডি ইন মসলিন' (ঢাকা, ১৭৮৯) । ছবি- উইকিপিডিয়া
প্রাচীন মসলিনে সর্বনিম্ন ৭০০/৮০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার হত, এজন্য মসলিন হত কাঁচের মত স্বচ্ছ। এটি এতই সূক্ষ্ম আর মিহি ছিল যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনকে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত। সে সময় এক গজ ঢাকাই মসলিনের মূল্য ছিল ৫০ হতে ৪০০ পাউন্ড বা বর্তমান কালের মূল্যমান অনুযায়ী ৭,০০০ থেকে ৫৬,০০০ পাউন্ড।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট নেপোলিয়নের পত্নী জোসেফিন তার অন্দরমহলে মসলিনের তৈরি পর্দা ব্যবহার করতেন। মোঘল বাদশাদেরও প্রিয় কাপড়ের তালিকায় ছিল মসলিন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যাও মসলিনের তৈরি কাপড় ব্যবহার করতেন।
ব্রিটিশ আমলের সবচেয়ে উন্নত সিল্কের কাপড়ের চেয়ে ঢাকাই মসলিন ছিল ২৬ গুণ বেশি দামী । ছবি- প্রথম আলো
অত্যন্ত দামী হওয়ার দরুণ বিভিন্ন দেশের রাজা, বাদশা, সম্রাট, সম্রাজ্ঞীরা তাদের আভিজাত্যের শান শওকত বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে মসলিনকে বেছে নিয়েছিলেন। অতি উচ্চ মানের ও মূল্যের এই মসলিন সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের দেহসৌষ্ঠব বৃদ্ধিতে অতুলনীয় বলে বিবেচিত হত।
প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক ছিল এই ঢাকাই মসলিন। ‘অ্যা স্কেচ অফ দ্যা টপোগ্রাফি এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস অফ ঢাকা’ বইয়ে মসলিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বইয়ের লেখক জেমস টেলর লিখেছেন, ‘ঢাকাই মসলিন মানুষের কাজ নয়। এটা পরীদের কাজ।’ অলীক অবাস্তব, হাস্যকর শোনালেও মসলিন তৈরির পেছনে জড়িয়ে আছে এমন হাজারো না বলা কথামালা।

এমন সুন্দর, দামী, সূক্ষ্ম, রুচিশীল ও আভিজাত্যের প্রতীক ঢাকাই মসলিন মূলত বিদেশী পরাশক্তির আক্রমণ, বাজার ধ্বস, কাঁচামালের অপ্রাপ্যতা, জলবায়ু পরিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
শিল্পীর আঁচড়ে ঢাকাই মসলিন বুনন । ছবি- বাংলাপিডিয়া
ঢাকাই মসলিনের উপর প্রথম আঘাত আসে ১৭৫৭ সালে, যখন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন। ইংরেজরা বাংলার অর্থনীতি এবং রাজনীতির সর্বেসর্বা হয়ে উঠে। ইংরেজরা বাংলায় আসে শুধু শাসন শোষণ করতে। এদেশের মাটি, মানুষ বা তাদের সংস্কৃতি ধারা বজায় রাখাকে তারা তাদের কর্তব্য বলে মনে করেনি। নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টিই ছিল উপনিবেশায়নের প্রধান লক্ষ্য।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়। স্বল্প সময়ে মেশিনের মাধ্যমে প্রচুর কাপড় ও পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। এসব পণ্যের কাঁচামাল এবং শ্রম বাংলা থেকে সরবরাহ করা হত। এছাড়াও ইংরেজরা মসলিন কাপড়ের কর বৃদ্ধি করে দেয়। ঢাকাই মসলিন যদি বিদেশে রপ্তানি করতে চায় তো সরকারকে ৭০%-৮০% কর দিতে হত, যেখানে ইংরেজদের মোটা কাপড়গুলো মাত্র ২%-৪% করের মাধ্যমে আমদানি করা যেত। বেশিদিন ব্যবহার করা যায় বলে এসব মোটা কাপড় এদেশীয় বাজার আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং দেশীয় তাঁত শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।

এমনও শোনা যায় যে, ইংরেজরা মসলিন তৈরির কারিগরদের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে দেয় যেন তারা এমন সূক্ষ্ম আর মিহি সুতা বুুনতে না পারেন। এমন জনশ্রুতিও আছে যে, এত দামী মসলিন বুনেও মুনাফালোভী মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য তাঁতিরা ন্যায্য দাম পেতেন না। এজন্য তারা নিজেরাই নিজের আঙ্গুল কেটে ফেলেন। যদিও এসব জনশ্রতির স্বপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক দলিল আজ অক্ষত নেই।

তবে ইংরেজদের মসলিনের প্রতি এ বৈমাত্রেয় আচরণের কারণেই ঢাকাই মসলিন তার গৌরব, মর্যাদা আর বাজার হারায় এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই শিল্পকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়।

বর্তমানে একদল গবেষকের প্রচেষ্টার ফলে আবার মসলিন শিল্প পুনর্জীবিত হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে উপযুক্ত গবেষণা, পরিশ্রম এবং কালক্ষেপণের মাধ্যমে আবারও হারিয়ে যাওয়া জাতীয় ঐতিহ্য ঢাকাই মসলিন তার গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারবে। ইতোমধ্যেই ২০২০ সালে মসলিনকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

লেখক

তথ্যসূত্র
১. The myth of Muslin: Epic journey of Muslin By Shariful Alom
২. A sketch of the Topography and Statistics of Dacca: James Taylor
৩. উইকিপিডিয়া
৪. বিবিসি বাংলা
পূর্ববর্তী পরবর্তী