রংপুরের শতরঞ্জি আমাদের আভিজাত্যের প্রতীক

বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য শতরঞ্জি। নকশিকাঁথার মত বুনন কৌশলে বিভিন্ন নকশা দিয়ে তৈরি করা একধরনের কার্পেট জাতীয় হস্তশিল্প এটি। রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে শতরঞ্জি বিত্ত-বৈভব ও আভিজাত্যের প্রতীক।
শতরঞ্জি । ছবি- টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স সোসাইটি
রংপুরের নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি গত ১৭ জুন, ২০২১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিকট থেকে বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রায় মানানসই ও কার্যকরী উপকরণ হতে পারে এই শতরঞ্জি।

শতরঞ্জি নাম যেভাবে এল
শতরঞ্জি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে আছে নানান মত ও ব্যাখ্যা। ফরাসি শব্দ শতরঞ্জ থেকে শতরঞ্জি শব্দের আবির্ভাব। এছাড়াও প্রচলিত আছে যে সম্রাট আকবরের দরবারে পাশা খেলার প্রচলন ছিল। পাশা খেলায় যে কাপড় বিছিয়ে খেলা হত সেই কাপড়কে বলা হত শতরঞ্জি। কেউ কেউ বলেন এখান থেকে শতরঞ্জির উৎপত্তি। তাছাড়াও আরেকটি মত পাওয়া যায় যে শতরঞ্জি অর্থ শত রঙের বাহার। নানান রঙের সমারোহে তৈরি হয় শতরঞ্জি। এ থেকেই শতরঞ্জি শব্দের উৎপত্তি।

বুনন আর নকশা
শতরঞ্জি তৈরির মূল উপকরণ হল পাট, কটন সুতা, সুতলি, শ্যানালসহ বিভিন্ন ধরনের ফাইবার। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম বুনন শিল্প শতরঞ্জি। অবাক করা বিষয় হল এ শিল্পে কোনো জটিল যন্ত্রের ব্যবহার হয় না। কাঠের ফ্রেম বা বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটির উপর সুতা টানা দিয়ে হাতেই তৈরি করা হয় গৌরবময় ঐতিহ্যের শতরঞ্জি।
শতরঞ্জি পল্লী নিসবেতগঞ্জ, রংপুরে শিল্পীর নিপুনতায় শতরঞ্জি নকশা হিসেবে এসেছে নারীর মুখ, পশুপাখি, রাখাল বালক, কলসি নিয়ে নারী, রাজা-রাণী, দেবদেবী, পৌরাণিক চরিত্র আর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এসব ডিজাইনে ভিন্নতা পাওয়া যায়। শতরঞ্জির নকশায় লাল, নীল আর কালো রঙের প্রাধান্য বেশি দেখা যায়।
শতরঞ্জির কর্মব্যস্ত শিল্পীগণ । ছবি- প্রথম আলো
শতরঞ্জির ব্যবহার
মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে আসন, শয্যা, সভা, মজলিস বা জলসায় বসার জন্য শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা বাদশাহ, বিত্তবানদের গৃহে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে শতরঞ্জির ব্যাপক কদর ছিল।
বর্তমানে এর নানাবিধ সৌখিন ব্যবহার রয়েছে। বসার ঘর বা খাবার ঘরে ফ্লোরম্যাট হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহার করা যায়। দেয়ালে মাদুর হিসেবেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ব্যাগ, ছোট কয়েন পার্স, টেবিল ম্যাট এবং উপহার সামগ্রীসহ কিছু কিছু সৃজনশীল পণ্যে শতরঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। শতরঞ্জি বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করা যায়। আর রানার হিসেবেও এটি বেশ দৃষ্টিনন্দন।

কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের নানান গৌরবান্বিত ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রংপুরের শতরঞ্জি। জার্মানির একটি মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য ২০০০ সালে আমন্ত্রণ পায় রংপুরের শতরঞ্জি। এরপর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর কদর বাড়তে থাকে। তরুণ উদ্যোক্তাগণের চেষ্টায় শতরঞ্জি ফিরে পেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া গৌরব। এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান যেমনি সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি বেগবান হচ্ছে দেশের অর্থনীতির চাকা।
বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় ৭০ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। শতরঞ্জি রপ্তানি করে গড়ে প্রায় ৪০ লাখ ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় রংপুরের মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক শতরঞ্জি আজ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বিত্ত বৈভব ও আভিজাত্যের প্রতীকে।


তথ্যসূত্র
১) বাংলাদেশ লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রংপুর (বাংলা একাডেমী)
২) দৈনিক ইত্তেফাক
৩) দৈনিক প্রথম আলো
৪) বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, রংপুর জেলা
৫) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, যবিপ্রবি
পূর্ববর্তী পরবর্তী