সাধারণ এই দেশি ফলের রয়েছে মরণঘাতী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা!

ফল পছন্দ করে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অতিথি আপ্যায়ন আর দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা পূরণে এর তুলনা নেই বললেই চলে। আমাদের বাড়ির আনাচকানাচে জন্মে বহু ফলের গাছ যার অন্যতম পেয়ারা। এটি আমাদের দেশের সর্বত্র চাষ করা সম্ভব। ফলে সব জায়গায় এটি সহজলভ্য। পেয়ারা খেতে খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় সকল বয়সের লোকজনের কাছে পেয়ারা একটি পছন্দনীয় ফল।
আমাদের দেশের হাটে বাজারে যত ধরনের ফল রয়েছে তার মধ্যে পেয়ারা খুবই সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। বিদেশি অনেক ফলের দাম উচ্চমূল্য হওয়ার পরেও আমরা ঐসকল ফল বেশি কিনি, কিন্ত দেশীয় এই ফল সুলভ মূল্যের হওয়ার পরও আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। অথচ এই ফলের পুষ্টিগুণ জানলে এর প্রতি এতোদিনের অবহেলার কারণে আফসোসই হবে!
পেয়ারা বা গয়া সাধারণত সবুজ রঙের হয়ে থাকে। তবে অন্যান্য বর্ণের পেয়ারাও দেখতে পাওয়া যায়। লাল পেয়ারাকে লাল আপেলও বলা হয়। পেয়ারার বৈজ্ঞানিক নাম Psidiun guajava। বিশ্বব্যাপী পেয়ারার প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রজাতি আছে।
পেয়ারাতে পাওয়া যায় ভিটামিন সি। আর ভিটামিন সি শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি করে শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া যে কোন ইনফেকশন থেকে পেয়ারা শরীরকে সুস্থ রাখে।
পেয়ারার রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধের গুণ । ছবি- ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ
লাইকোপেন (Lycopene), কোয়ারকেটিন (Quercetin), ভিটামিন সি এবং আরো কিছু পলিফেনল আছে যা কিনা শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। আর এই এন্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুকি কমায়। বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যান্সার কমাতে অনেক সাহায্য করে পেয়ারা। আর সেই সাথে পেয়ারা খেলে মেয়েদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
পেয়ারাতে ফাইবার এবং কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স থাকার কারণে এটি খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে আর তাই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকি কিছুটা কম থাকে।
পেয়ারা শরীরের সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম এর ব্যালান্স বাড়ায়, যা কিনা ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। পেয়ারা ট্রাইগ্লিসারাইড এবং LDL নামক একটি খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় যার ফলে হার্টের অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। রক্তে চর্বি কম জমে এর ফলে। একই সাথে এই পেয়ারা HDL নামক একটি কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় যা কিনা হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
পেয়ারা একটি ফাইবার জাতীয় ফল আর তাই এটি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় আর তাই কারো ঠিকমত পায়খানা না হলে পেয়ারা খেয়েই করতে পারেন আপনার সমস্যার সমাধান।
পেয়ারাতে ভিটামিন এ আছে আর যার কারণে এটি খেলে তা আমাদের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া এটি খেলে চোখের ছানি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়।
পেয়ারাতে আছে ফলিক এসিড। আর ফলিক এসিড একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই প্রয়োজন। সব গর্ভবতীকেই ডাক্তাররা ফলিক এসিড দিয়ে থাকেন। কারণ এটি বাচ্চার নার্ভাস সিস্টেমকে উন্নত করে। আর সেই সাথে এটি বাচ্চাদের নিউরোলোজিক ডিজঅর্ডার থেকে দুরে রাখে।
পেয়ারাতে আছে প্রচুর ভিটামিন সি এবং সাথে আয়রন, যার কারণে এটি কফ দূরীকরণে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কারো যদি কফ জমে যায় গলায়, তাহলে সেক্ষেত্রে পেয়ারা খুব ভাল ওষুধ। এতে বিদ্যমান আয়রন, ভিটামিন সি শ্লেষ্মার মাত্রা কমিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং ঠাণ্ডাজনিত যেকোনো সমস্যার সমাধান দেয়।
ফলের পাশাপাশি পেয়ারার পাতায়ও রয়েছে পুষ্টিগুণ । ছবি- লেখক
পেয়ারার পাতায় আছে এন্টি-ইনফ্লামেটরি গুণ। এর খুব শক্তিশালী এন্টি-ব্যাক্টেরিয়াল ক্ষমতা আছে যা কিনা ইনফেকশনের সাথে যুদ্ধ করে এবং জীবাণু ধবংস করে। আর তাই পেয়ারার পাতা দাঁত ব্যথার জন্য খুব ভাল একটি ওষুধ, যা কিনা আপনি ঘরে বসেই দূর করতে পারবেন।
পেয়ারাতে ম্যাগনেসিয়াম থাকার কারণে এটি মাংশপেশিকে এবং নার্ভকে রিলাক্স রাখতে সাহায্য করে। আর তাই অনেক কাজ শেষে অথবা অনেক স্ট্রেস নেয়ার পর একটি পেয়ারা খেয়েই আপনি আপনার এনার্জি লেভেলকে পারেন বাড়াতে ।
পেয়ারাতে পাওয়া যায় ভিটামিন বি৩ এবং ভিটামিন বি৬ যা কিনা ব্রেনের রক্ত সঞ্চালনকে ভাল রাখতে সাহায্য করে।
অনেকেরই মুখের ভেতর সাদা দাগের মত একটি আলসার দেখা যায় আর এটি হয়ে থাকে ভিটামিন সি এর অভাবে, তাই পেয়ারা খেলে এটি হওয়া অনেকটা কমে যায়।
পেয়ারাতে গ্লুকোজের পরিমাণ কম থাকে আর তাই ওজন কমানোতে এটি বেশ ভাল একটি প্রতিষেধক।
পেয়ারা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সাথে লড়াই করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
অনেক নারীরই মাসিককালীন পেট ব্যথা করে থাকে। প্রচন্ড ব্যথার কারণে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেই ব্যাথার ঔষধ সেবন করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যদি কেউ পেয়ারার পাতা চিবিয়ে বা রস করে খায় তাহলে পিরিয়ডে হওয়া সেই ব্যথা দ্রুত সেরে যায়, সেইসাথে শরীরে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ফেলে না। আর তাই যারা প্রতিমাসে পিরিয়ডের ব্যথা নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ভোগেন তাদেরকে বলবো খাবারের তালিকায় এখনই পেয়ারাকে রাখার চেষ্টা করুন। কারণ, আপনাদের জন্য আদর্শ ফল হলো পেয়ারা এবং পেয়ারা পাতার রস, যা খুব সহজেই আপনার মাসিককালীন ব্যথা উপশমে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
শুধু বর্ষাকালে পেয়ারা পাওয়া গেলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের কারণে বছরের সবসময়ই দেখা যায়। ১০ লাখ ৪৭ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন করে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম স্থানে রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পতিত জমিতে আরো বেশি করে পেয়ারা উৎপাদন করতে পারলে আমাদের দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বাড়ির আঙ্গিনায় ২/৩ টি পেয়ারা গাছ থাকলে পরিবারের লোকজনের কিছু জরুরি পুষ্টিচাহিদা ভালোভাবে মিটানো সম্ভব। আমাদের দেশীয় এই ফলকে অবহেলা না করে প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ করতে হবে এবং এর পুষ্টিগুণ সবার মাঝে তুলে ধরতে পারলে বিদেশি ফলের উপর চাপ কমিয়ে দেশীয় এই ফলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ানো সম্ভব হবে।

লেখক

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
পূর্ববর্তী পরবর্তী