পান খাওয়া ছাড়াও সুপারির রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার

বাংলাদেশে সুপারি চেনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতিতে মিশে আছে পান-সুপারি। দেশের সব অঞ্চলে মেহমান আপ্যায়নে পান-সুপারির জুড়ি মেলা ভার। পান-সুপারি নিয়ে রচিত হয়েছে কত আবেগঘন গান! বর্তমান বাংলাদেশে সুপারি একটি অন্যতম অর্থকারী ফসলও বটে।
ভাওয়াইয়ার চটকা মেজাজে রচিত রংপুরের আঞ্চলিক গান ‘গুয়া (সুপারি) খায়া না খাইনু চুন, সেবা গুয়ার কিবা গুণ’।
সুপারির ইংরেজি প্রতিশব্দ Betel Nut, যার বৈজ্ঞানিক নাম Areca Catechu। সংস্কৃতিতে সুপারিকে বলা হয় গুবাক। সুপারি বাংলাদেশে ‘গুয়া’ নামেও পরিচিত। ধারণা করা হয়ে থাকে সংস্কৃত গুবাক থেকে গুয়া নামের উৎপত্তি। তাছাড়া অবিভক্ত ভারতবর্ষে সুপারির ইতিহাসে জানা যায়, প্রাচীন পশ্চিম ভারতের সুপ্পারক বা সোপারা বন্দর দিয়ে আরব ও পারস্যে রপ্তানি হত গুয়া। বেনিয়ারা গুয়াকে বলত সোপারা। এই সোপারা শব্দই সামান্য পরিবর্তন হয়ে সুপারি নামে ছড়িয়ে পড়ে।
সুপারির নানান উপকারিতা থাকলেও খাবার হিসেবে নিয়মিত খেলে এটি নীরব ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে । ছবি- প্রথম আলো
আবাদ
সাধারণত জুন-জুলাই মাসে সুপারি গাছে ফুল আসে এবং নভেম্বর মাস থেকে ফল পাকা শুরু হয়। কাঁচা ফল দেখতে সবুজাভ এবং পাঁকা ফল হলদে। পাঁকা সুপারি থেকে চারা তৈরি করা হয়। প্রতি ১৫ সে. মি. দূরত্বে ৫ সে. মি. গভীরে সুপারি রোপণ করতে হবে। সাধারণত ৫০-৫৫ দিনে সুপারি থেকে চারা গজায়। হালকা ছায়াযুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে জমি সুপারি চাষের জন্য উত্তম। প্রতি ৬ ফিট অন্তর গর্ত করে পঁচা গোবর বা জৈব সার দিয়ে সুপারির চারা লাগাতে হয়। সাধারণত ৫-৮ বছরে গাছে ফল আসা শুরু হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে সুপারি চাষ বেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় রয়েছে সুপারির বাগান। সুপারির হিসাব করা হয় পণ বা পোন ও কাহন বা কাউন-এ। ৮০ টি সুপারিতে হয় ১ পোন এবং ১৬ পোনে হয় ১ কাহন। সুপারির হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩.৪৫ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে দেশে বছরে প্রায় ২৬ হাজার ৫শ মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদিত হয়।

ঔষধি ব্যবহার
সুপারির কিছু ক্ষতিকর দিক থাকলেও এর রয়েছে বেশ কিছু ঔষধি গুণ। যেমন-
+ গুড়া ক্রিমির উপদ্রব হলে সুপারি থেঁতো করে পানিতে সেদ্ধ করে খেলে উপশম পাওয়া যায়।
+ সুপারি থেঁতলে কাঁচা বেলসহ সেদ্ধ করা পানি খেলে রক্ত আমাশয় সেরে যায়।
+ ঘা পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ হলে কাঁচা সুপারি শুকিয়ে থেঁতলে লাগালে দুর্গন্ধ ও ঘা সেরে যায়।
কুড়িগ্রামে নিজের সুপারি বাগানে লেখক
নানাবিধ ব্যবহার
প্রতি বছর দেশের বাজারে সুপারি বিকিকিনি হয় কয়েকশ কোটি টাকার। সুপারির আকার ও রং ভেদে ১ পোন (৮০ টি) বিক্রি হয় ১৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সুপারি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। তাছাড়া সুপারি গাছের কান্ড ঘরের খুঁটি, মাঁচা, সিলিং তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সুপারির খোসা দিয়ে তৈরি হয় হার্ডবোর্ড। সুপারি গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় ঝাড়ু, ঝুড়ি, মাদুর ইত্যাদি। সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। থালা, বাটি, কাপ, নাস্তার ট্রে, ঘড়ি, ফটোফ্রেম, জুতাসহ বাহারি সব পণ্য যা রুচিসম্মত ও পরিবেশবান্ধব।
এছাড়াও সুপারি বাগানে সাথী ফসল হিসেবে লটকন, চুই, আদা, হলুদ চাষ করেও কৃষক আর্থিকভাবে আরো লাভবান হতে পারে।

প্রতি বছর দেশে সুপারি বাগানের সংখ্যা যেমনি বাড়ছে তেমনি বাড়ছে সুপারির নানামুখী ব্যবহার। সুপারির বিচিত্র ব্যবহারে ভূমিকা রাখছে দেশের তরুণ উদ্যোক্তাগণ। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, দূর হচ্ছে বেকারত্ব, সর্বোপরি শক্তিশালী হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

লেখক

তথ্যসূত্র
কৃষি বাতায়ন
বাংলাপিডিয়া
লালমনিরহাট কৃষি অফিস
প্রথম আলো
ডেইলি স্টার
উইকিপিডিয়া
পূর্ববর্তী পরবর্তী