ভেষজ উদ্ভিদের আত্মকথা

আজকাল চারপাশে শুধু ভেষজ দ্রব্য, ভেষজ উদ্ভিদের নাম শোনা যায়। রোগের চিকিৎসায়, রুপচর্চায়, খাবারের তালিকায় নিত্য নতুন ভেষজ পণ্যের সংযোজন হচ্ছে। অনেকেই হয়ত অল্প ধারণা রাখে ভেষজ কথাটির মানে কী বা আদৌও জানেই না! তাই আজকে সবার উদ্দেশ্যে ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে ছোট্ট একটি পরিচিতিমূলক লেখা। তাহলে শুরু করা যাক।
তুলসী । ছবি- লেখক
প্রথমেই বলে ফেলি ভেষজ উদ্ভিদ কথাটির সঠিক সংজ্ঞা। সাধারণত যে সকল উদ্ভিদ আমাদের রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য করার ক্ষমতা রাখে তাদেরকেই ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করি। যেমন ধরুন তুলসি বা নিম গাছ আমাদের চির পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংজ্ঞার মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি দিক উন্মোচিত হয়। ভেষজ উদ্ভিদের পরিধি আরো বড়। যে সকল উদ্ভিদ সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং মানুষের দেহের কার্যক্রম পরিবর্তন করতে পারে তারাই হলো ভেষজ উদ্ভিদ। যেমন অনেকেই বলেন এক কাপ চা/কফি না খেলে ভালো লাগে না, চা/কফি যেনো দেহকে সতেজ করে তোলে। তাহলে চা/কফি কি ভেষজ দ্রব্য নয়? কী! অবাক হলেন তো এটা শুনে?

আরো মজার বিষয় হলো আমরা স্বাদের জন্য যে মসলাগুলো প্রতিদিনের খাবারের সাথে ব্যবহার করি তারাও কিন্তু ভেষজ উদ্ভিদ। তারা প্রতি নিয়ত আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, পাচন ক্ষমতা, হরমোন, এনজাইমগুলোকে উদ্দীপিত করেই চলেছে। আমরা আমাদের অজান্তেই কত ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে চলেছি তা কখনো বুঝতেই পারি না। এখন হয়ত অনেকের মনে প্রশ্ন জেগে উঠেছে, এগুলো যে ভেষজ উদ্ভিদ জানলাম কীভাবে? বা মানুষ জানে কীভাবে কোনগুলো ভেষজ উদ্ভিদ আর কোনগুলো না? এই প্রশ্নের উত্তর একটু জটিল তবুও চেষ্টা করবো সহজভাবে তুলে ধরার।

ধারনা করা হয় ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার বহু আগে থেকে। কৃষিক্ষেত্র তখনো বিকাশ না হওয়ায় খাদ্যের জন্য মানুষ উদ্ভিদ আর পশুপাখির উপর নির্ভরশীল ছিলো। সেই সময়ে কেউ কোনো উদ্ভিদ খেয়ে যদি কোনো অসুখ সেরে যেতো বা শারীরিক কোনো উপকার পেতো তাহলে সেটা তারা মনে রাখতো। পরবর্তীতে কিছু কিছু সম্প্রদায়ের মানুষজন বংশপরম্পরায় এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম এই তথ্যগুলো মনে রাখতো। এইভাবেই মূলত এই তথ্যগুলো বর্তমানে আমাদের কাছে এসেছে।

এর ভালো উদাহরণ হলো আমাদের গ্রামের এক খালা। কারোর কোনো সমস্যা হলে তার কাছে যায় কোনো টোটকা আছে কি না। কী বলবো! আমার ভাইয়ের জন্ডিস হয়েছিলো তখন আমিও তার কাছে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। তিনি আমার ভাইকে একটি গাছের শিকড় খেতে বলেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার রহমতে সে গাছের শিকড় খেয়ে সে সুস্থ হয়ে উঠেছিল।

জেনে আশ্চর্য হবেন যে সারা পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভেষজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। আর এই তালিকায় স্থান পেয়েছে দরিদ্র দেশের মানুষ আর বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী যাদের কাছে এখনো আধুনিকতার ছোয়া পৌঁছায়নি। এলোপ্যাথিক ঔষধ আসার আগে অবশ্য আমরা সবাই ভেষজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এলোপ্যাথিক যেসকল ঔষধ ব্যবহার করি তার উৎপত্তি কিন্তু বেশি দিন না। এই কয়েক যুগ আগে এলোপ্যাথিক ঔষধ জনসাধারণের মাঝে আসে। তারপর দেখা যায় এলোপ্যাথিক ঔষধ ভেষজ উদ্ভিদের তুলনায় সক্রিয় যৌগের মাত্রা উচ্চপরিমাণে থাকায় খুব দ্রুত কাজ করে, অল্প ঔষধেই রোগ সেরে যায়। ফলে খুব দ্রুতই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার কমে যায়। যেমন আমরা ছোটবেলায় কেটে গেলে দূর্বাঘাসের রস বা গাঁদা ফুলের পাতার রস ব্যবহার করতাম, ভালো হয়ে যেতো। এখনো কোথাও কেটে গেলে আশেপাশে তাদের খোঁজ করি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম বিশেষ করে শহরের ছেলে-মেয়েদের কেটে-কুটে গেলে দেখি বিভিন্ন এন্টিসেপ্টিক ক্রিম ব্যবহার করতে। দূর্বাঘাস বা গাঁদা ফুলের পাতাও যে খুব ভালো কাজ করে তাদেরকে এটি আপনি বলে বোঝাতে পারবেন না, ব্যবহার করা তো পরের বিষয়। আবার গ্রামের ছেলেমেয়েদের ঠিকই দূর্বাঘাসের উপর পূর্ণ আস্থা আছে। হয়ত সেখানে যেদিন এই এন্টিসেপ্টিক ক্রিম সহজলভ্য হয়ে পড়বে তারাও হয়ত আর দূর্বাঘাসের খোঁজ করবে না।

যাইহোক, ভিতরের খবর হলো এলোপ্যাথি ঔষধের উৎস কিন্তু এই সকল ভেষজ উদ্ভিদই। বিজ্ঞান যখন উন্নতি লাভ করে যৌগ শনাক্ত করতে সক্ষম হলো, তখন এই ভেষজ উদ্ভিদের অভ্যন্তরে থাকা রোগ নিরাময়কারী সক্রিয় যৌগগুলোকে বের করে নিয়ে এসে তাদেরকে আলাদাভাবে ব্যবহার শুরু করলো। দেখা গেলো সেগুলো ব্যবহার করলেই চলে আর ভেষজ উদ্ভিদের প্র‍য়োজন হয় না। এইভাবে তারা কোন রোগে কোন ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার হয় তা জেনে তাদের সক্রিয় যৌগগুলো আলাদা করে সনাক্ত করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করলো। তারা সেই যৌগগুলোকে বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন এবং ব্যবহার শুরু করলো, ফলে এলোপ্যাথি নামে চিকিৎসার একটি নতুন পদ্ধতির যাত্রা শুরু হলো।
অপরাজিতা । ছবি- লেখক
কিন্তু এতদিনে এসে ধীরে ধীরে এলোপ্যাথির প্রধান সমস্যাগুলো সাইড ইফেক্ট হিসেবে সামনে ভেসে আসছে। ফলে এলোপ্যাথির অগ্রাধিকার ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। আমরা ছোটখাটো সমস্যায় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করি অথবা এলোপ্যাথি কাজ না করলে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করি। আরেকটি মজার বিষয় হলো ভেষজ উদ্ভিদের কোনো সাইড ইফেক্ট নাই বলে বর্তমানে অনেকেই এলোপ্যাথি ঔষধ পরিহার করে আবার ভেষজ উদ্ভিদে ফিরে আসছে। তাই বলে বাজারে পাওয়া নামিদামি ভেষজ ঔষধের উপর নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিলেই হবে না আবার। কারণ তারাও যে খাঁটি জিনিস দিচ্ছে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আমাদের দেশে প্রচুর গাছপালা ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও ব্পোক ব্যবহারের ফলে ঘাটতি দেখা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো ব্যবসায়িক ভেষজ বাগান নাই। ফলে ঘাটতি কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না যার ফলে ভেজাল দেয়া হচ্ছে। এর ভালো উদাহরণ অর্জুন গাছ। আমি যখনই দেখি অর্জুন গাছের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছাল নাই। সেটি যে দেখতে কেমন জানি না। এপর্যন্ত সুস্থ অর্জুন গাছ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এমনকি দূর থেকে কোনো বাকলবিহীন গাছ চোখে পড়লে ধরেই নিই সেটা অর্জুন গাছ!

এইবার একটু কাজের কথায় আসি। আমরা চাইলেই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিজ বাসাতেই করে ফেলতে পারি। এমনকি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধও করতে পারি কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই। কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আচ্ছা উদাহরণ দিয়ে আরেকটু বুঝিয়ে বলি। এই ধরুন মাথায় চুল পড়ার সমস্যার জন্য বাজার থেকে অ্যালোভেরার পাতা, মেহেদি পাতা কিনে নিয়ে আসি। তার চেয়ে আমার নিজের একটা টবে চারা লাগিয়ে সেখান থেকে প্রয়োজন মতো পাতা সংগ্রহ করে নিলে ভালো না?

জানি আমার কথা শুনে অনেকেই ছাদে কিছু ভেষজ উদ্ভিদ লাগাতে আগ্রহী হয়েছেন। কিন্তু কী কী লাগানো যায় এই নিয়ে একটু চিন্তায় আছেন। তার সমাধানও আমি দিয়ে দিচ্ছি। ছাদ বাগানের উপযোগী প্রসিদ্ধ কিছু ভেষজ উদ্ভিদ যেমন বাসক, তুলসী, নিম, অ্যালোভেরা, অর্জুন, আমলকি, থানকুনি, কালোমেঘ, মেন্দা, নিশিন্দা, অপরাজিতা, আদা, উলটকম্বল, কাগজীলেবু, অশ্বগন্ধা, আমরুল ইত্যাদি যেকোনো নার্সারিতে পাওয়া যাবে। এদের শুধু ভেষজ গুণই নয় সাথে সৌন্দর্যবর্ধক কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে। তাই চাইলেই বাসার ছাদে কিছু ভেষজ উদ্ভিদ টবে করে যত্ন লাগিয়ে নিলে নিজের শারীরিক সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি মানসিক চাহিদাও নিজেই মিটাতে পারি।
বাসক । ছবি- লেখক
বলতে বলতে তো অনেক কথাই বলে ফেলেছি, তাই আজকে এখানেই ইতি টানলাম। তবে আবার ফিরে আসবো নতুন কিছু চমক নিয়ে। ভেষজ উদ্ভিদের অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আগামী পর্বে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক
সিদ্দিক হাসান
শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পূর্ববর্তী পরবর্তী