রহস্যে ঘেরা আলীর গুহা: মর্তের বুকে অন্য এক পৃথিবী
দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি দূর করার যত উপায় আছে, তার মধ্যে ‘হাওয়া বদল’ হয়তো বেশি কার্যকরী। শহুরে ক্লান্তি কিংবা দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়ার স্বাদ কেবল প্রকৃতির সান্নিধ্যেই পাওয়া যায়। যদিও হাওয়া বদলের সেকালের বিশুদ্ধ বায়ু একালে পাওয়া বেশ দুষ্কর। তবুও দেশের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্যের আধারে ডুব দিলে এখনও মন রোমাঞ্চিত হয়। অবচেতন মনে উচ্চারিত হয়, ‘এত সুন্দর! এত সুন্দর!’
অসাধারণ আলোকচ্ছটার দেখা পাবেন পুরোটা পথ । ছবি- লেখক |
সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চ! কিংবা বলতে পারেন সবুজের শান্ত প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়া যাবে বান্দরবানের যেকোন পথে-ঘাটে-পাহাড়েই। তবে পাহাড় কিংবা ঝর্ণা ছাড়াও বান্দরবানের লুকায়িত সৌন্দর্যের নাম হলো ‘গুহা’। শান্ত, সৌম্য প্রকৃতির সাথে রহস্যময় ‘আলীর গুহা’ বান্দরবানের আলীকদমে অবস্থিত দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এই গুহাটি ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ নামেও পরিচিত। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় মংচুপ্রু পাড়ায় গেলেই এ গুহার সন্ধান মেলে। গুহার প্রবেশমুখটা এত নিরিবিলি ঠিক যেন ওখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়া যায়। আলীর গুহা ভালোভবে পুরোটা দেখতে চাইলে আপনাকে ঘুম থেকে উঠেই সূর্যকে সাথে নিয়ে প্রবেশ করতে হবে।
গুহামুখে কাঠের সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে ঝিরিঝিরি বয়ে চলা নালার পানির মৃদুমন্দ লয় শুনতে শুনতে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন প্রকৃতির বিশুদ্ধতা। শরীর জুড়ে নদীর জলের ঠাণ্ডা হাওয়া অনুভব করতে করতে দেখবেন আপনার সময় ওখানেই থেমে গিয়েছে। কিংবা একটা মৃদু ছন্দে আপনি আঁটকা পড়েছেন। এই মোহ কাটিয়ে কিছুদূর এগোলেই সূর্যের উঁকি দেখবেন গুহার ঝোপঝাড় ছাড়িয়ে আপনাকে কেন্দ্রীভূত করে নিয়েছে।
গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে পাড়ি দিতে হবে সরু বিচিত্র পথ । ছবি- লেখক |
হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে অথবা হাঁটুজল মাড়িয়ে কখনও প্রশস্ত দাঁড়াবার জায়গা, কখনওবা সরু দেয়ালে চেপে কোনো রকম যেতে পারবেন গুহার অভিমুখে। বন্ধু কিংবা পরিবারের সাথে স্মৃতি রক্ষায় ক্যামেরাবন্দী ক্লিকে একটু জিরোতেও পারবেন মাঝেমধ্যে। এরপরেই প্রথম গুহায় প্রবেশের সিঁড়ি পাবেন আরেকটা সরুগলির ভিতর দিয়ে যেতে। গুহার উপরে উঠতে বর্তমানে স্থানীয় সরকারের সহায়তায় সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও পর্যটকদের ভার বহন করতে করতে সেগুলো বেশ নাজুক। তাই উপরে উঠতে গেলে সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে কয়েক বছর আগেও সিঁড়ি ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে গাছের ঝুলে থাকা ঠেসমূল দিয়েই উৎসাহী তরুণেরা গুহায় প্রবেশ করতো। যাদের একটু সাহস কম তারা সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় গুহায় যাবেন কিনা এটার সিদ্ধান্ত নেয়া কষ্টকর। সিঁড়ি একেবারেই নাজেহাল কিনা! ট্যুরিস্টদের মধ্যে তরুণদের গানের শব্দ আপনাকে অন্যভুবনে নিয়ে যাবে। গুহার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তৈন খালের স্বচ্ছ টলটলে জলে নেমে গোসলও সারতে পারেন।
গুহায় প্রবেশ করতে হলে নড়বড়ে সিঁড়ি পেরোনোর ঝুঁকি নিতেই হবে । ছবি- লেখক |
পুরো ভ্রমণে আপনাকে মনে রাখতে হবে,
গুহার ভিতরে পুরোটাই অন্ধকার। ভিতরে যাওয়ার জন্যে আপনাকে অবশ্যই টর্চ বা মশাল ব্যবহার করতে হবে।
গুহাগুলোর ভিতরে ছোট বড় অনেক বাদুড় আছে এবং মানুষ দেখে সেগুলো এদিক-সেদিক উড়বে। বাদুড়গুলো কিন্তু একেবারেই আক্রমণ করবে না। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
গুহার কিছু অংশ বেশ সরু, হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। ভিতরে স্যাঁতস্যাঁতে গা ছমছমে পরিবেশ।
চিপসের প্যাকেট কিংবা প্লাস্টিকের বোতল যেখানে-সেখানে ফেলবেন না।
বাস্তবের গুহার সৌন্দর্য আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে । ছবি- লেখক |
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী যেকোন বাসে যাওয়া যাবে চকরিয়া। যারা বাস ভ্রমণ পছন্দ করেন না, তারা ট্রেনে চট্টগ্রাম চলে যাবেন। সেখান থেকে চকরিয়া। চকরিয়া নেমে সেখানকার নতুন বাস টার্মিনাল থেকে আলীকদম যাবার জিপ গাড়ি বা চান্দের গাড়ি পাওয়া যায়। একসাথে কয়েকজন থাকলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করেও আলীকদম যেতে পারবেন। এছাড়া কয়েকটি বাসও যাতায়াত করে এই রুটে। বাসে গেলে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা লাগবে আর চান্দের গাড়িতে গেলে ৩০-৪০ মিনিটের মত কম সময় লাগবে।
শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হতে পারবেন তৈন খাল । ছবি- লেখক |
আলীকদম পৌঁছে স্থানীয় বাজারে খেয়ে নিতে পারেন পাহাড়ি মুরগী, সবজি, ভাত। স্থানীয় বাজার থেকে পছন্দের ফলমূলও কিনে নিতে পারেন। আলীকদম থেকে মংচুপ্রু পাড়ায় হেঁটে বা ইজিবাইকে যাওয়া যাবে। প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ। মংচুপ্রু পাড়ার পর তৈন খাল পেরিয়ে একটু হেঁটে গিয়েই পাবেন গুহামুখ। ফেরার সময় যানবাহন পাওয়া কঠিন হবে। তাই আসা-যাওয়ার জন্য একবারে রিজার্ভ গাড়ি নেয়াই নিরাপদ। জুতা, ব্যাগসহ ভারি জিনিসপত্র গাড়িতেই রেখে যাবেন।
মোটামুটি সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় থাকলেও শীতকাল আলীর গুহায় যাওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে বর্ষাকালে যাওয়া যাবে না। আলীর গুহা দেখে আপনি একদিনে ঘুরে আবার রাতেই ঢাকায় ফিরতে পারবেন। কিন্তু অন্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে চাইলে কিংবা পাহাড়ে রাতে ক্যাম্প করতে চাইলে বেছে নিতে পারেন কাছেপিঠের কোনো হোটেল।
লেখক